অঙ্কন কুহুকে কলেজে দিয়ে এসে নিজে ভার্সিটি তে গেলো আর ভাবছে লেটার টা পড়ার পর কুহুর রিয়েকশন কি হবে! অঙ্কনের ভাবনা গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হচ্ছে। ওইদিকে কুহু লেটারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ক্লাসে ঢুকলো। সন্ধ্যায় বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে কুহু লেটারটা পড়তে বসলো। কুহুর চোখ তখন চড়কগাছ৷ লেটারে লিখা ছিল,,
"দেখো কুহু ভনীতা আমার পছন্দ নয় তাই সরাসরি বলছি আমার তোমাকে ভালো লাগে। না ভালো লাগে তা ঠিক না, আসলে ভাল বেসেই ফেলেছি। ডায়েরিতে লিখছিলাম কথাগুলো। তাই ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে তোমাকে দিলাম। কার্বন কপি আছে আমার কাছে। যাইহোক, আমি তোমার অনেক সিনিয়র এইটাই ভাবছো তো তুমি? তুমি হয়ত ৪/৫ বছরের সিনিয়র কাউকে বিয়ে করবে। সেখানে আমি ৭ বছরের সিনিয়র। এতে লাভটা কার জানো? তোমার লাভ। কারণ আমি তোমায় আরো বেশি করে বুঝবো। রিলেশনের দরকার নেই। তুমি হ্যা বললে তোমার মা বাবাকে জানিয়ে আমি তোমায় বিয়ে করে নিয়ে আসব। বিয়ের পরে ভালবাসবো। আর শুনো তোমাকে আমি শুধু আমার মনের কথাটাই বলেছি। তুমি রাজি না থাকলে বন্ধুত্ব টা নষ্ট করনা। কাছের কোনো বন্ধুকে যদি আজীবন কাছে রাখা যায় তাতে ক্ষতি কি? তুমি না চাইলে এই টপিকস আজকে এইখানেই শেষ।"
চিঠিটা পড়ে কুহু রাগে ফাটছে। ঘরের মধ্যে পাইচারী করে কুহু নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে রিংটোন বাজালো যাতে মনে হয় কেউ ফোন দিয়েছে। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কেমিস্ট্রি নোটখাতা নিয়ে আর খাতার মধ্যে চিঠিটা। ড্রইংরুমে রাইসা আর আম্মু বসেছিলো।
-কিরে কুহু কোথায় যাচ্ছিস? (আম্মু)
-তানিমের বাসায়।
-কেন?
-শুনলানা তানিমের সাথে কথা বললাম। কিছু নোটস লাগবে নিয়ে আসি। (মিথ্যে কথা)
-আমি কি যাব নাকি একাই যেতে পারবি? (রাইসা)
-না একাই পারবো।
তানিমদের বাসা কুহুর বাসার পাশের লেনে। কুহু থাকে ১৬ নাম্বার রোডে আর অঙ্কন ১৭ নাম্বার রোডে। কুহুর মিশন এখন অঙ্কনের বাসায় যাওয়া কিন্তু তা তো আর আম্মুকে বলা যাবেনা তাই মিথ্যে বলতে হলো। কুহু বাইরে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটা ধরলো ১৭ নাম্বার রোডের প্রথম বাড়ির পাঁচতলার উদ্দেশ্যে। ১০ মিনিট লাগলো কুহুর অঙ্কনের রুমে আসতে। পাঁচতলা উঠে হাঁপিয়ে গেছে কুহু। বেল বাজাচ্ছে আর গলার ঘাম মুচছে। অঙ্কন বিরক্ত হয়ে দরজা খুলল কারণ ও ঘুমাচ্ছিলো। অঙ্কন কুহুকে দেখে বারবার চোখ ডলছে। ঘুমের ঘোরে ভুল দেখছে না তো? কুহু অঙ্কনকে ধাক্কা মেরে ধুম করে ঘরে ঢুকে যায় আর দরজা লাগিয়ে দেয়।
-কুহু তুমি? এই রাতে? (অবাক হয়ে অঙ্কন)
-এই শ্রী তেই বুঝি থাকেন বাসায়? (অঙ্কনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে কুহু)
-কেন খারাপ কি? (থ্রি কোয়ার্টার টানতে টানতে অঙ্কন)
-খালি গায়ে কেন? (চোখ রাঙিয়ে কুহু)
-আরে আজব আমি তো খালি গায়েই থাকি বাসায়। একটু পর নামাজ পড়তে যাব তখন পাঞ্জাবি পড়ব। (কম্বল দিয়ে শরীর ঢেকে) আমি কি করে জানবো হুট করে তুমি চলে আসবে।
-আমি না এসে যদি অন্যকোনো মেয়ে এসে আপনাকে এই অবস্থায় দেখতো?
-তুমিই প্রথম মেয়ে যে আমার ঘরে এসেছো। (টি শার্ট পরতে পরতে অঙ্কন)
-আর আমিই যাতে শেষ হই! (টি শার্টের নেক ধরে কুহু)
-মানেহ?
কুহু কেমিস্ট্রি খাতা থেকে লেটার টা বের করলো আর লাস্ট লাইনটা দেখালো আর বলল,
-এই টপিকস এখানেই শেষ না, কেবল শুরু। আজ থেকেই শুরু। আর হ্যা আপনাকে আমি আপনি আপনি করতে পারবনা। তুমি বলব। আপত্তি থাকলেও শুনবো না। (অঙ্কনের খাটে বসে কুহু)
-বিশ্বাস করতে পারছিনা।
-আপনাকে বলছি আমি বিশ্বাস করতে? (টি টেবিলের উপর থেকে ছুড়ি নিয়ে অঙ্কনের গলায় ধরলো কুহু)
-এই মেয়ে কি করছো? একজন পুরুষের ঘরে এসে এইভাবে তার উপর অত্যাচার করতে লজ্জা করছে না তোমার? (চোখ বন্ধ করে অঙ্কন)
-না করছেনা কারণ পুরুষটা এখন আমার।
-এই মেয়ে আস্তে। সাবধানে কথা বলো৷ প্রপোজাল কবে পাঠাবো?
-আগে তো প্রেম করি এরপর বিয়ে। মিনিমাম ৩/৪ বছর প্রেমই করব। এরপর বিয়ে।
-আমাকে দিয়ে প্রেম ট্রেম হবেনা।
-হওয়ায় ছাড়বো। চিনো আমাকে? আসফিয়া ....
-চৌধুরী কুহু। মনে আছে। (কুহুর কথা শেষ না করতে দিয়ে অঙ্কন)
-ভেরি গুড। আর ঘরের অবস্থা এমন কেন? ওই কোনায় বিরিয়ানির প্যাকেট না ওইটা?
-হ্যা।
-খাচ্চর! প্যাকেট নিয়ে ডাস্টবিনে ফালাতে হয়। আর এইগুলো কি? স্ট্যান্ড ফাঁকা অথচ জিন্স আর শার্ট টি টেবিলের উপরে?
-আমি এইগুলা গুছাই না। বুয়া মাঝে মাঝে গোছায়। গোছানো কাজটা আমায় দিয়ে হয় না।
-বিছানার চাদর ধোও না কত বছর ধরে?
-৩/৪ বছর হবে। (চোখ মেরে অঙ্কন)
-একমাস পর পর চাদর উঠাবা আর শোনো বুয়াকে না করবা তোমার কোনো জিনিসে হাত দিতে। প্রতিদিন কলেজ থেকে ডিরেক্ট তোমার বাসায় আসবো আর আমি গুছিয়ে দিয়ে যাব।
-তুমি তো দেখছি আমাকে ত্যাজপাতা বানানোর জন্য রেডি? এইত জাস্ট এক্সেপ্ট করলা আর এখনি এতকিছু। কুহু প্লিজ তুমি না অনেক শান্ত মেয়ে, শান্ত থাকো। বাই দ্য ওয়ে তুমি আমাকে তুমি বলছো? হাও রোমান্টিক ইউ আর!! (হাসতে হাসতে অঙ্কন)
-বেশি কথা না বলে এই যে কেমিস্ট্রি খাতাটা দিয়ে গেলাম। অর্গানিক কেমিস্ট্রির রিয়েকশন গুলো সলভ করে দিও। আযান দিচ্ছে মসজিদে যাও। আমিও নামাজ পড়ব বাসায় গিয়ে।
কুহু চলে যেতে নেয় আবার তখনি পিছু ফিরে অঙ্কনের সামনে এসে দাঁড়ায়।
-এইভাবে দাঁড়াইলা কেন? (অঙ্কন)
-তুমি আমায় প্রপোজ করছো? (ভ্রু উঁচু করে কুহু)
-এসব পারিনা আমি।
-পারাচ্ছি ওয়েট!
এরপর কুহু অঙ্কনকে দাঁড় করায় জোর করে। কুহুর হাইট অঙ্কনের বুক পর্যন্ত। তাই কুহু অঙ্কনের বিছানার উপর উঠে অঙ্কনের গলা জড়িয়ে ধরলো।
-ওই কি করছো তুমি? প্রেম করাই ঠিক না তার উপর করছো আর এসব হারাম। বিয়ে করি তারপর যা খুশি করো। এখন ছাড়ো বাবা! (কুহুর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে অঙ্কন)
-তোমায় একটা সিরিয়াস কথা বলি?
-হ্যা বলো।
-সত্যি সত্যি তুমি আমাকে ভাল বাসোনা?
-এনি ডাউট?
-কালই তুমি আমায় বিয়ে করবে বাট কেউ জানবেনা। আমরা আমাদের মতই থাকবো। তোমার কাছের মানুষ রাও জানবেনা। শুধু তুমি আর আমি ছাড়া।
-কেন? না জানিয়ে আমি বিয়ে করব কেন?
-আমার আব্বু কোনোদিন মেনে নিবেনা আমাদের সম্পর্ক টা। আমায় মেরে ফেলবে তবুও মেনে নিবেনা। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোমায় অনেক ভালবাসি। (খাট থেকে নেমে কুহু) তোমার পার্সোনালিটি, তোমার সবকিছু আমার ভাল লেগেছে। আমি সত্যিই তোমাকে ভালবাসি। তুমি না বললেও আমি তোমায় জানাতাম আমার কথাগুলো। আমি বিয়ে করব এই জন্য যে আব্বু যাতে বাধ্য হয়ে মেনে নেয় আমাদের। তাছাড়া তোমার কেউ নেই এইটা জেনে আরো আগে রাজি হবেন না।
-কুহু আমিও তোমায় ভালবাসি কিন্তু তুমি যেখানে নিশ্চিত যে তোমার বাবা আমাকে মানবেন না সেখানে কিভাবে আগাবো আমরা?
-এতকিছু তো আমি জানিনা। আমার তোমাকে লাগবে। তুমি আমায় ভালো বাসলে কালই আমায় বিয়ে করবা। আব্বু যখন আমায় বিয়ে দিতে চাইবে তখন আমি তোমার কথা আব্বুকে বলব। এর আগে নয়। বৈবাহিক কোনো সম্পর্ক না থাকুক কিন্তু কালই বিয়ে কর আমায় প্লিজ। (কেঁদে কেঁদে কুহু)
-এইটা একদম ই অনুচিত কুহু। তুমি আজকে ভেবে কালকে আমাকে ফাইনাল ডিসিশন জানাও।
-আমি যা বলেছি তাইই হবে। বিয়ে আমরা কালই করছি। আসছি আমি। (চোখ মুছে কুহু)
-দাঁড়াও আমি পাঞ্জাবিটা পড়ে আসি। একা একা বের হইয়ো না।
অঙ্কন দ্রুত পাঞ্জাবিটা পরে কুহুকে নিয়ে বের হয়ে যায়। কুহুকে ওর বাসার নিচে দিয়ে অঙ্কন সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে মসজিদে যায়। রাহাত অঙ্কনকে উদসীন দেখে জিজ্ঞেস করে,
-কি হয়েছে ভাই?
-কিছুনা। আয় ভেতরে আয়।
অঙ্কন নামাজ পড়ে বাসায় এসেও সেই একই কথা ভাবছে। কুহু কি আবেগের বসে করছে সব? নাকি সত্যি সত্যি কুহু ওকে ভালবাসে? ভালো না বাসলে তো কোনো মেয়ে বিয়ে পর্যন্ত যায় না। আমিও তো ওকে ভালবাসি। প্রথম ভালবাসা! ওকে তো আমিও ভুলতে পারবো না। কালকে কি তাহলে রেজিস্ট্রি করাবো? ঠিক হবে কাজটা? হাজার ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে অঙ্কনের মনে কিন্তু শেষ সিদ্ধান্তে ও কিছুতেই আসতে পারছেনা। পরে শেষ রাতে ও ডিসিশন নিয়েই ফেলে ও কুহুকে কালই বিয়ে করবে। পরে যা হবে দেখা যাবে।
পরেরদিন বিকালবেলা.....
অঙ্কন মাঠের পাশে বসে আছে। একটু আগেই ও কুহুকে বিয়ে করেছে। খুশিটা যতটা প্রবল তার চেয়ে ভয়টাই দ্বিগুণ। কুহুকে বাসায় দিয়ে এসে ক্রিকেট খেলার মাঠে বসে আছে অঙ্কন। রাহাত আর শিহাব অনেকবার ডাকে অঙ্কনকে খেলার জন্য কিন্তু অঙ্কন খেলবে না বলে সবাই অনেকবেশি অবাক হয়। মাথা নিচু করে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে ও। তখনি কুহু ফোন করে।
-হ্যা বলো। (ফোন রিসিভ করে অঙ্কন)
-কোথায় তুমি?
-মাঠে
-খেলছো?
-না বসে আছি। তুমি কি কর?
-চেঞ্জ করলাম মাত্র। রাতে একটু পার্লারে যাব। নিয়ে যাবা?
-পার্লারে কেন?
-আম্মু সবসময় বলে স্বামীর মঙ্গলের জন্য নাকফুল পড়তে হয়। আমার নাকফুল আছে, আব্বু পাঠিয়েছিলো। কিন্তু নাক তো ছিদ্র করা নেই। তাই যেতাম।
-এইসব বিশ্বাস করা ঠিক না কুহু। নাকফুলে কিছু আসে যায় না। (যদিও মনে মনে অঙ্কন ভীষণ খুশি) তাছাড়া হঠাৎ করে নাকফুল পরলে তোমার মা সন্দেহ করবেনা?
-না করবেনা। মা আমাকে অনেকদিন থেকেই বলছে নাক ছিদ্র করতে। আমিই ইগনোর করতাম। কিন্তু আমি চাইনা আমার জন্য আমার বরের কিছু হোক। সন্ধ্যায় মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকো। আমি আসব।
-তানিমের কথা বলে বের হইয়ো।
-হ্যা সেইটাই ভাবছি। বাসায় গিয়ে খাও। আমি একটু পর আবার ফোন দিচ্ছি।
-আচ্ছা। আল্লাহ হাফেজ।
ফোন কাটার পর অঙ্কন ভীষণ খুশি হয় কুহুর বলা কথাগুলো ভেবে। অঙ্কন ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাহাতকে বলে,
-ওই আমি আসছি। আমাকে ছাড়া কিভাবে খেলছিস তোরা?
অঙ্কন মাঠে খেলতে শুরু করে। মাগরিবের আজান দিলে মসজিদে চলে যায়। নামাজ পড়ে এসে দেখে কুহু মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-কখন আসছো?
-এইত এখন। চলো।
-মুখ ঢাকা কেন?
-কেউ দেখে ফেললে!
-আমাকে বলবে ওই দেখো অঙ্কন কোন মেয়ের সাথে হাঁটে। হাহাহা। (মজা করে অঙ্কন)
-এক কাজ কর। তুমি আগে যাও। আমি পিছু পিছু আসছি।
-ধ্যাৎ! রিক্সা নিলেই হয়।
অঙ্কন একটা রিক্সা নিলো। আজ আর কুহুর পাশে বসতে ওর দ্বিধা নেই কারণ আজ কুহু লিগাল। ওর নিজের বউ কুহু। আর কেউ না জানলেও আল্লাহ সাক্ষী সাথে ওরা দুইজন।
চলবে....................
0 মন্তব্যসমূহ